রাজনীতি

শর্ত দিয়ে সংলাপ, শর্তহীন সংলাপ

35views

সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী জানুয়ারিতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই সময়ে নির্বাচন হলে আসছে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে ইসি। নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচনের ৪৫ দিন আগে তফসিল ঘোষণা করতে হয়।

নির্বাচন যখন এত কাছে তখনো কিন্তু এই নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের পরিবেশ বিদ্যমান। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বিএনপি, এমনটা জানিয়েছে তারা। তাদের একটাই দাবি—নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই দাবিতে এক দফার আন্দোলনেও আছে দলটি। এদিকে, সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় যাবে না। তারা তাদের ভাষায় সংবিধান অনুযায়ী সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে চায়। প্রধানমন্ত্রীসহ সকল মন্ত্রী-এমপিরা একই কথা বলছেন। জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে যত রাজনৈতিক দলের তাদের কেউই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার নির্বাচনেও আগ্রহী নয়। অথচ এই ব্যবস্থায় যেতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে, আর সংবিধান সংশোধনে লাগবে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন। সরকার-দল আওয়ামী লীগের আছে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সংসদ সদস্য। তারা যখন চাইছে না, তখন এ দাবি পূরণ হচ্ছে না বলা যায়। কেবল তারাই নয়, সংসদের কোন সদস্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় আগ্রহী নয়।\

২০১৮ সালে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে গিয়েছিল বিএনপি। তাতে তাদের ফল বিপর্যয় হয়েছিল। তাদের ভাষায়—‘দিনের ভোট রাতে হয়েছিল’। অথচ গত পৌনে পাঁচ বছরে এই রাতের ভোটের প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি তারা। মৌখিক অভিযোগেই থেকে গেছে সেটা। তাদের এই অভিযোগকে আবার অনেকেই আমলে নিয়েছেন, অনেকেও বলেন; এমনকি নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বশীলরাও অনেক সময় নিজেদের নিরপেক্ষ প্রমাণেও বলে ওঠেন, আগামীতে দিনের ভোট দিনেই হবে। রাতের ভোটের এই তত্ত্ব গোয়েবলসীয় ধারা, নাকি সত্য—এর দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপিত হয়নি যখন তখন এটাকে আমলে নেওয়া যৌক্তিক কি-না এনিয়ে আমরাও সন্দিহান। তবে ওই নির্বাচনে দৃশ্যমান অনিয়ম না হলেও হয়তো তেমন কিছু ঘটেছে যা সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিবন্ধক, যা আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি দলগুলোকে নির্বাচনবিমুখ করে দিয়েছে।

আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গবেষণাকর্মে অনীহার বিষয়টি প্রকাশ্য বলে গত নির্বাচন নিয়ে তাদের কোন বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়নি। পরাজয়ের কারণ তারা উচ্চারণ করেছে একবাক্যে—‘কারচুপি’। এই একটা শব্দ অতিব্যবহারে অনেকটাই আবেদনহীন। আমাদের সহজাত ধারণা বিজিতরা বিজয়ীদের সহ্য করতে পারে না। ওই নির্বাচনেও সেটা ঘটেছে, তবে সত্যাসত্য যা কিছু তার উপস্থাপনে যেখানে যুক্তি আর গবেষণার আশ্রয় নেওয়ার কথা ছিল তার কিছুই ছিল না। ফলে কারচুপি নামের ওই শব্দটি পূর্ব-ধারণাজাত হিসেবেই থেকে গেছে। অথচ কারচুপি শব্দকে বিশ্বাসযোগ্য করতে দালিলিক প্রমাণের দরকার ছিল বৈকি!

২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে, নির্বাচন হয়েছে, এবং অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ওই নির্বাচনের পরে দেশে-বিদেশে অনেক আপত্তি ওঠেছিল, কিন্তু সেসব মোকাবেলা করে পুরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকেছে আওয়ামী লীগ। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির ফল বিপর্যয়ের পরেও অনেক আপত্তি-সমালোচনা-আলোচনা সত্ত্বেও পাঁচ বছর ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। আসছে নির্বাচনের আগে আবার আছে নির্বাচন বর্জনের হুঁশিয়ারি। তবে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। কারণ যেকোনো মূল্যে নির্বাচন হবে বলে ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়ে বসে আছে ক্ষমতাসীন দল। যদিও নির্বাচনের ঠিক আছে দেশের চাইতে বেশি রয়েছে বিদেশি চাপ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমেরিকা বাংলাদেশের জন্যে ভিসানীতি ঘোষণা করে দেশে একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। যে যতই অস্বীকার করুক না কেন এর প্রভাব ইতোমধ্যেই পড়েছে দেশের সকল স্তরে। প্রশাসনের নিচের স্তর থেকে সর্বোচ্চ, এমনকি সাধারণ মানুষের মাঝেও আছে এর আলোচনা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও আছে ব্যাপক আলোচনা।

এবার নির্বাচনের আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল এসেছে। এসেছে মার্কিন প্রাক নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। নির্বাচনে মার্কিন পর্যবেক্ষক দল আসবে কি-না এটা মূল্যায়ন করতে গত ৭ অক্টোবর ঢাকায় এসেছিল মার্কিন প্রতিনিধিদল। পর্যবেক্ষক দলটি সে দেশের দুই গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইন্সটিটিউটের (এনডিআই) প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত। বাংলাদেশ সফরে তারা মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন, আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, বিদেশি কূটনীতিকসহ অংশীজনদের সঙ্গে অন্তত ২০টি বৈঠক করে। সফর শেষে তারা তাদের প্রতিবেদন দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে পাঁচটি পরামর্শ দিয়েছে তারা।

এই পাঁচ পরামর্শের মধ্যে অন্যতম প্রধান বিষয়টি হচ্ছে সংলাপ। সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ। প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রশংসা করেছে। বলছে, বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার রূপকল্প অর্জনের ক্ষেত্রে একটি ভিত্তি স্থাপন করেছে। অর্থনৈতিক এই অগ্রগতি সত্ত্বেও কিছু চ্যালেঞ্জের কথা বলেছে তারা, যার মধ্যে রয়েছে—আপসহীন রাজনৈতিক মানসিকতা, আক্রমণাত্মক বক্তৃতা, রাজনৈতিক সহিংসতা, অনিশ্চয়তা, ভয়ের পরিবেশ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়া, আস্থার অভাব। এটা বাংলাদেশের ইতিবাচক অগ্রযাত্রাকে বিঘ্নিত করতে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের। প্রতিনিধি দলের প্রতিবেদনে, আগামীকে নির্বাচনকে তারা ‘লিটমাস টেস্ট’ হিসেবে অভিহিত করেছে।

মার্কিন প্রতিনিধি দলটি যে সুপারিশ দিয়েছে তার প্রধান হচ্ছে সংলাপ। কিন্তু দেশে এই সংলাপের পরিবেশ কতখানি রয়েছে—এ প্রশ্নটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে এটা নিয়ে এখনো যার যার অবস্থানেই অনড় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান অনুযায়ী সরকারের অধীনে নির্বাচন, অন্যদিকে বিএনপির দাবি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সংলাপ যদি এই ইস্যুতেই হয়, তবে সংলাপের ফলাফল সহজেই অনুমেয়।

মার্কিন এই প্রতিনিধি দলটি বিএনপির সঙ্গেও দেখা করেছিল। বিএনপি স্বাভাবিকভাবেই তাদের মূল দাবির কথা বলেছে, কিন্তু মার্কিন এই দলটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে জোরালো কিছু বলেনি। আমেরিকার ভিসানীতি-সৃষ্ট প্রবল রাজনৈতিক চাপ, ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলগুলোর মন্তব্য এবং মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে নির্দলীয় সরকারের প্রসঙ্গে বারবার তাদের কাছ থেকে কথা বের করার চেষ্টায় বিএনপি অদ্যাবধি সফল হয়নি। সংলাপ এবং রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে নানা কথা বলেও আদতে সেটা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পর্যন্ত পৌঁছায়নি। এদিকে, আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার নানামুখী চাপের মধ্যে থাকলেও এই চাপের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার বিষয়টিও থাকছে না। এই চাপ কেবল বিএনপি তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে দিয়ে যাচ্ছে। দেশের বাইরে থেকে আসছে না।

নির্বাচনের আগে সংলাপ হবে কিনা, এটা এখনো নিশ্চিত নয়। প্রতিবারই নির্বাচনের আগে এই সংলাপ-সংলাপ আওয়াজ ওঠে। কিছু সংলাপও হয়। রাষ্ট্রপতির আয়োজনে হয়, নির্বাচন কমিশনের আয়োজনে হয়। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল ওসবে অংশও নেয়। সংলাপ থেকে কিছু হয় না বললেও ফি-বার তারাও ওসবে অংশ নেয়। এবারের সংলাপের আলোচনাও এর ব্যতিক্রম বলে মনে হচ্ছে না।

এবার কি সংলাপ হবে? মার্কিন প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের সুপারিশের পর সেই একই প্রশ্ন ওঠেছে। বিএনপির সঙ্গে কোন সংলাপ হবে না—আওয়ামী লীগ নেতারা আগে এমন বললেও অদ্য বলছেন, শর্তহীন সংলাপে তাদের আপত্তি নেই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপি চায় প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নির্বাচন কমিশন বাতিল করা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। সংলাপের চিন্তা করব তখন, যখন তারা (বিএনপি) চারটি শর্ত প্রত্যাহার করে নেবে। শর্তযুক্ত কোনো সংলাপের ব্যাপারে আমাদের কোনো চিন্তাভাবনা নেই। শর্ত তারা প্রত্যাহার করলে দেখা যাবে।’ আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, ‘মার্কিন প্রাক নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল যে কথাগুলো বলেছেন, তার প্রায় সবগুলো মেনে ফেলেছি। দেশে একটি সংবিধান আছে এবং সেই সংবিধানে বলা আছে নির্বাচন কীভাবে হবে। দেশে আইনও আছে। সংবিধান ও আইন মেনে নির্বাচন হবে। সংবিধানের বাইরে বা প্রচলিত আইনে যা আছে, তার বাইরে কোনো সংলাপ হতে পারে না।’ এদিকে, আবার বিএনপির এক দফা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। এখন সংলাপ যে হবে সেখানে যদি এমন শর্ত থাকে, তবে সেই সংলাপের ফলাফল অনুমেয়।

শর্তহীন সংলাপ, আবার এক দফা দাবি বাস্তবায়নের শর্তে সংলাপ—বিষয়টি পরষ্পরবিরোধী। এখান থেকে কিছু আশা করা যায়? যায় না! নিজেদের দাবিকে এখানে এজেন্ডা করতে মরিয়া দুপক্ষই। অথচ এজেন্ডা হওয়া উচিত ছিল সুষ্ঠু নির্বাচন।

সরকার দল আওয়ামী লীগ বলছে শর্ত বাদ দিয়ে এসো, বিএনপি বলছে শর্ত মেনে বসো—এগুলো মূলত শর্তই। পরস্পরবিরোধী এই শর্তে আদতে সংলাপের সম্ভাবনা তিরোহিত হয়ে যায়। ফলে আমরা যা চাই সেটা আদতে না হওয়ার শঙ্কাটাই প্রবল হয়ে ওঠেছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করতে চায় আওয়ামী লীগ। আগেও করেছিল তারা। এদিকে, এটা মানতে চাইছে না বিএনপি। এমন অবস্থায় উত্তপ্ত হতে পারে দেশ, হতে পারে প্রাণ আর সম্পদের অপচয়। এমনটা চাই না আমরা যদিও, তবে সে শঙ্কা দিন-দিন প্রবল হয়ে ওঠছে।

Leave a Reply