রাজনীতি

আ’লীগ-বিএনপি উভয়কেই ‘ছাড়’ দেওয়ার আহ্বান

55views

আগামী নির্বাচন সামনে রেখে চলমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে শুরু হয়েছে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা। প্রকাশ্যে ও পর্দার আড়ালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠকে বসছেন পশ্চিমা কূটনীতিকরা। এসব বৈঠকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘাত-সহিংসতা কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয় জানিয়ে তা এড়াতে দুই দলকেই কিছুটা ‘ছাড়’ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে নিজ নিজ অনড় অবস্থান থেকে সরে ‘সমঝোতা’র পথ বের করার প্রস্তাব দিয়েছে কূটনৈতিক মহল। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে আইনগত কী কী বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছা যায়– তা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। অবশ্য মধ্যস্থতার ভূমিকা থেকে পশ্চিমা কূটনীতিকদের দেওয়া সুনির্দিষ্ট এ প্রস্তাবে এখনও ইতিবাচক সাড়া দেয়নি কোনো পক্ষ। পাল্টাপাল্টি আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে দুই দলই। তার পরও ‘হাল’ ছাড়ছেন না প্রভাবশালী দেশের প্রতিনিধিরা।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সমঝোতার উদ্যোগের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ইতোমধ্যে পৃথকভাবে বেশ কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হন ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। সর্বশেষ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বৃহস্পতিবার দুপুরে আমেরিকান ক্লাবে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেন পিটার হাস। যদিও ওই বৈঠকের খবর ফাঁস হওয়ার পর মির্জা ফখরুল কৌশলগত কারণে তা অস্বীকার করেন। তবে বৈঠক হয়েছে বলে বিএনপির একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করে জানিয়েছেন। অবশ্য এর আগে আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতার সঙ্গেও বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। দুই দলের দুই শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি কোনো পক্ষই।

নাম প্রকাশ না করে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকগুলোতে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক সংকট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সংকট থেকে কীভাবে উত্তরণ সম্ভব, তার পথ খোঁজার বিষয়েও দুই দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। বাংলাদেশের সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি এড়াতে সমঝোতার উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত পশ্চিমা অন্যান্য দেশের কূটনীতিকের মতামতও তুলে ধরে ওই সূত্র। একই সঙ্গে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে উভয় পক্ষকে কিছুটা ছাড় দিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানানো হয়। তারা আশা করে, সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি এড়াতে দু’পক্ষই এগিয়ে আসবে এবং সংলাপে বসবে। সমঝোতার জন্য সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। সংবিধানের ভেতর-বাইরে কোনো পথ আছে কিনা, তা দেখা যেতে পারে। বিএনপিও তাদের বর্তমান অবস্থান থেকে কিছুটা ছাড় দিতে পারে কিনা– এ বিষয়গুলো নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে তাদের ভাবার আহ্বান জানানো হয়েছে।

অবশ্য মার্কিন রাষ্ট্রদূতের তৎপরতা সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের মুরব্বির সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। তলে তলে যখন সব শেষ, তখন এসব করে কী লাভ?

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক সমকালকে বলেন, কূটনীতিকদের তৎপরতা থাকতে পারে। তবে আওয়ামী লীগ এই বিষয়ে এত বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয় না। অবশ্য কূটনীতিকরা কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেননি। তারা শুধু বলছেন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা। দুই দলকে ছাড় দেওয়ার বিষয়ে কূটনীতিকদের আহ্বান সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, এখানে ছাড় দেওয়ার কিছু নেই। আমরা সব সময় বলে আসছি, সংলাপ অপরিহার্য। তবে তা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে নয়, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কীভাবে আরও সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে হবে, তা নিয়েই সংলাপ হতে পারে।

অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ চায় না। তারা অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। দুই দলকে ছাড় দিয়ে সমঝোতার বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের আহ্বান সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার শান্তিপূর্ণ সমাধানের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনাই সবচেয়ে উত্তম পথ।

অবশ্য কূটনীতিকদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সব পক্ষকেই সংঘাত ও সহিংসতা পরিহার করা উচিত। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকাই বেশি। সৃষ্ট সংকট নিরসনে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে তার দায়ভার সরকারের ওপরই বেশি বর্তাবে। পাশাপাশি বিরোধী দলের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করা উচিত।

 

বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যদি সত্যি কূটনীতিকরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে উদ্যোগ নিয়ে থাকেন, তা ইতিবাচক। অতীতেও বিদেশিদের উদ্যোগেই অনেক প্রচেষ্টা হয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারই লাভবান হয়েছে। রাজপথে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। সংলাপ প্রয়োজন। দুই দল যেভাবে অনড় অবস্থানে রয়েছে এবং নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাতে সংঘাত অনিবার্য। এতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাজনীতিবিদরাও ভুগবেন বলে জানান তিনি।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র তিন মাস বাকি। নভেম্বরে তপশিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অথচ রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সরকারের পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। চলতি অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের মধ্যেই রাজপথে ফয়সালা করার হুমকি দিচ্ছে তারা।

অন্যদিকে, সংবিধানের অধীনেই নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির কর্মসূচির বিরুদ্ধে ‘শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ’ নামে পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে তারা। বিভিন্ন স্থানে ঘটছে সংঘাত ও সহিংসতা। সামনে বিএনপিকে প্রতিরোধের হুমকিতে সংঘাত আরও বাড়তে পারে। একই সঙ্গে পুরোনো ও নতুন মামলায় বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সাজা ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ অবস্থায় সামনে কোন পথে যাবে রাজনীতি– এ প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। রাজনৈতিক এই অস্থিতিশীলতার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছে। প্রতিনিধি দল আগামী নির্বাচন সম্পর্কে সবার সঙ্গে আলোচনা করে পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করেছে। তবে ওই প্রতিনিধি দলকে প্রধান দুই দল তাদের ‘অনড়’ অবস্থানের কথাই পুনর্ব্যক্ত করেছে। ছাড় না দেওয়ার মনোভাব পোষণ করছে দুই পক্ষই।

এ পরিস্থিতির মধ্যেই ঢাকা আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার। আগামীকাল রোববার ঢাকা ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনের (আইওআরএ) সম্মেলনে যোগ দিতে আসছেন তিনি। সফরকালে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন, রাজনৈতিক দলসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারেন এ মার্কিন প্রতিনিধি।

বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছে উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা সরকার, বিরোধী দলসহ বিভিন্ন শ্রেণির নাগরিকের সঙ্গেও আলোচনা করে আসছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছে মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। দিল্লি সফরকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও বৈঠক হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে সফরকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান। যদিও বৈঠকটি প্রথমে গোপন রাখা হয়েছিল। অবশ্য ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল জি২০ সম্মেলনের আগে জ্যাক সুলিভানের সঙ্গে বাংলাদেশ ইস্যুতে আলোচনা করেন। ওইসব বৈঠকে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের বিষয়ে ভারতের ভূমিকা রয়েছে। তবে সেই বৈঠক নিয়ে চলছে রাজনৈতিক বিতর্ক।

অবশ্য ভারত এখনও তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বাধাদানকারীদের জন্য নতুন ভিসা নীতিও ঘোষণা করেছে। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না বলেও জানিয়েছে। এ পরিস্থিতির মধ্যে জি২০ স্পিকারদের একটি বৈঠকে যোগ দিতে নয়াদিল্লি গেছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। সেখানে তিনি ভারতের স্পিকার ও পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন। বৈঠকগুলোতে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হবে। আগামীতে আওয়ামী লীগের আরও কয়েকজন শীর্ষ নেতার ভারত সফরের গুঞ্জন রয়েছে।

Leave a Reply