মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী:
ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ে। বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে। বৃষ্টি পড়ে শহরে। বৃষ্টি পড়ে নগরে। বৃষ্টি পড়ে মাঠে। বৃষ্টি পড়ে ঘাটে। বৃষ্টি পড়ে হাটে। বৃষ্টি পড়ে খালে। বৃষ্টি আর বৃষ্টি। সকালে বৃষ্টি। দুপুরে বৃষ্টি। বিকালে বৃষ্টি। রাতে বৃষ্টি। সারা দিন বৃষ্টি। এত বৃষ্টি কে ঝরায়? কেন ঝরায়? বৃষ্টি কি সৃষ্টির উন্মাদনা? বৃষ্টি কি শিশুর মুখের হাসি? বৃষ্টি কি যুবতীর প্রেম? বৃষ্টি কি কাঁথা মুড়ো দেওয়া ঘুমের ওম? বৃষ্টি কি রবের গোপন ইশারা? বৃষ্টি কি মুমিনের ইমানের জানালা? বৃষ্টি কি কাফেরের কলবে খিল দেওয়া দরোজা?
আসলে বৃষ্টি হলো রবের খেলা। যাদের চোখ আছে, যাদের চোখ নেই, যাদের হুঁশ আছে, যাদের হুঁশ নেই, যাদের বোধ আছে যাদের বোধ নেই; সবার জন্যই বৃষ্টির খেলা খেলছেন মাবুদ রাব্বানা। দুনিয়ার বুকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরিয়ে মুমিনের ইমানের জানালা খুলে দেন আল্লাহতায়ালা। আবার একই বৃষ্টি দিয়ে কাফেরের কলবের দুয়ারে খিল এঁটে চিরতরে জাহান্নামি বানিয়ে দেন মাবুদ রাব্বানা।
দুনিয়াবাসীকে উদ্দেশ করে আল্লাহ বলছেন, ‘হে মানুষ ভালো করে জেনে রাখ! দুনিয়ার জীবন হলো অনর্থক খেলতামাশা, রংবেরঙের সাজ-পোশাক, সম্পদ-সন্তানের বড়াই ছাড়া কিছুই নয়। এ যেন এক পশলা বৃষ্টির মতো। বৃষ্টি দেখে চাষির মন আনন্দে ভরে ওঠে। বর্ষণের ফলে ফসলে ছেয়ে যায় খেত। ফসল কাটার স্বপ্নে আনন্দে নেচে ওঠে চাষির মন। কিন্তু হায়! কাটার আগেই নষ্ট হয়ে যায় শস্য। তাজা ফসল পরিণত হয় মরা খড়কুটোয়। আরও জেনে রাখ! পরকালের জীবনে রয়েছে শাস্তি ও ক্ষমা। সাবধান! দুনিয়ার জীবন সাংঘাতিক প্রতারণা।’ (সুরা হাদিদের ২০ নম্বর আয়াতে ভাব তরজমা।)
দুনিয়া বড় খারাপ জায়গা। বড় ভঙ্গুর স্থান। এখানে আসল কিছু নেই। সবই মেকি। খেল-তামাশা। চোখ ধাঁধানো মিথ্যে জৌলুস। মন ভোলানো মিথ্যে গৌরব। এ দেখ আমি কত সম্পদ করেছি, এ দেখ আমার কত সন্তান-আত্মীয়-বন্ধু আছে। যেমন একজন কৃষক বলে, দেখ দেখ কী ভীষণ বৃষ্টি ঝরছে! এবার আমার মেলা ফসল হবে। বৃষ্টি দেখেই বিশাল খেতজুড়ে হইহুল্লোড় করে বীজ রুয়ে দেয় কৃষক। ধারদেনা করে খেতে সেচ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। রাত জেগে, দিন মাটি করে খেত পাহারা দেওয়া কৃষক যখন দেখে ফসল নয় সব খড়কুটোয় পরিণত হয়েছে, তখন তার কেমন লাগে? একই অবস্থা তুখোড় দুনিয়াদার বন্ধুর ক্ষেত্রেও। হঠাৎ এক দুপুরে তার জীবনে কল্যাণের বৃষ্টি নামে। ফাঁকা পকেটে জোয়ারের পানির মতো টাকা আসতে থাকে। জমি-স্বর্ণ-গাড়ি-ফ্ল্যাটে ফুলে ফেঁপে ওঠে তার জীবন। চারদিকে ভিড় জমায় আত্মীয়-বন্ধুরা। মনে মনে তার সুখের সীমা নেই। এত সম্পদ এত আত্মীয় পৃথিবীতে আর কার আছে? নিজেকে সে মহা সুখী চির সুখী সেরা সুখী ভাবতে থাকে। কয়েক বছরের মাথায় যখন সব শেষ হয়ে যায়, স্ত্রী যখন আর তার স্ত্রী থাকে না, সন্তান যখন তার সন্তান থাকে না, আত্মীয় যখন তার চেয়ে তার সম্পদের দিকে লোভ করে বেশি, বন্ধু যখন দুধের মাছি প্রমাণিত হয়, তিল তিল করে গড়া সম্পদ যখন একে একে নিঃশেষ হতে থাকে; তখন সে বুঝতে পারে পাকা ফসল ভেবে এতদিন সে খড়কুটো যত্ন করেছে। বেশির ভাগ মানুষের তখনো হুঁশ হয় না। পাগল হয়ে যায় স্ত্রী-পুত্র-সম্পদের শোকে। ভাঙা নৌকা আবার জোড়া লাগানোর জন্য উঠে পড়ে লাগে। আবার একই ভুল। এভাবেই ঝরে যায় জীবনের ফুল। তবে কিছু মানুষের হুঁশ ফিরে আসে। সে বুঝতে পারে দুনিয়া এক মন ভোলানো রংতামাশার জায়গা ছাড়া কিছুই না। এখানে যাই করা হবে, যে ফসলই রোয়া হবে, শেষে তা খড়কুটোয়া পরিণত হবে।
দুনিয়ার জীবনের অসারতা বোঝাতে গিয়ে আল্লাহ বৃষ্টির উদাহরণ দিয়েছেন। কৃষকের হাসির কথা বলেছেন। হাসি শেষে মাথায় হাত দিয়ে কৃষক কান্না করছেন সে দৃশ্যও দেখিয়েছেন আল্লাহতায়ালা। আসলে আমাদের সবার জীবনেই বৃষ্টি ঝরে। কখনো সম্পদ কখনো সন্তান কখনো প্রতিপত্তি কখনো বন্ধুর বৃষ্টি এসে আমাদের মুখে অনাবিল হাসি ফুটিয়ে তোলে। আমরা ভেবে সুখী হই এবার বুঝি খারাপ সময় কেটে গেল। একটু সাবধানে চললে আর দেখতে হবে না অমঙ্গলের দিন। আর থাকতে হবে না বন্ধুহীন নিঃসঙ্গ। না খেয়ে কাটাতে হবে না সকাল-দুপুর। কান্নার দিন শেষ। হাসির দিন শুরু। আমরা সুখে পাগল হয়ে যাই। পাগল হয়ে আল্লাহর কথা ভুলে যাই। নবীকে ভুলে যাই। আখেরাত ভুলে যাই। শুরু হয় আমাদের দুনিয়ায় ডুব দেওয়ার সর্বনাশা খেলা। একটু ডুব দিয়ে মাথা তুলে দেখি সব ঠিক আছে কি না। আবার ডুব দিই। আরও গভীরে যাই। আবার মাথা তুলে দেখি সব ঠিক আছে কি না। এভাবে সাবধানে ডুব দিতে দিতে এক সময় আমাদের ভয় চলে যায়। পা পিছলে পড়ার ভয় যখন থাকে না তখনই আমরা দুনিয়ার গভীরে ডুব দিই। দিন-রাত মাটি করে দুনিয়ার ফসলগুলোতে পানি দিতে থাকি। ফসল বড় হয়। চোখের সুখ বাড়ে। এক সময় আমরা চূড়ান্ত ডুব দিই দুনিয়ায়। আর তখনই আল্লাহ ধরেন শক্ত করে। ফলে আর উঠতে পারি না আমরা। দম বন্ধ হয়ে আসে। চোখ অন্ধ হয়ে আসে। শরীর অচল হয়ে আসে। সম্পদ-স্বজন-সম্মান এক নিমিষে ধুলোয় মিশে দূরে উড়ে যায়। এ হলো দুনিয়ার জীবন। এখানে কোনো কিছুই সত্য নয়। কোনো কিছুই সঠিক নয়। আপন নয়। বন্ধু নয়। স্বজন নয়। টাকা থাকলেও কাজে আসে না। টাকা না থাকলেও বাঁচা যায় না। আত্মীয়-বন্ধু থাকলেও লাভ হয় না। আত্মীয় বন্ধু না থাকলেও সুখ আসে না। এক কথায় জীবন দুর্বিষহ যন্ত্রণায় পরিণত হয়। আখেরাতের আজাব তো বাকিই রয়েছে। আল্লাহ আমাদের বোঝার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর